মো: আল আমিন (বিশেষ প্রতিনিধি)
১৫ অক্টোবর, ২০২৫, 12:25 PM
সেনা কর্মকর্তাদের বিচার নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম সংক্রান্ত একটি মামলায় ২৫ জন বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বেসামরিক আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের এত বড় সংখ্যক বিচারপ্রক্রিয়া এই প্রথম, যা আইনি কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, সামরিক বাহিনীর মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে যে ২৫ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৫ জন কর্মরত সেনা কর্মকর্তা। এর মধ্যে রয়েছেন একজন মেজর জেনারেল, সাতজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, একজন কর্নেল, চারজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও একজন মেজর। এছাড়া একজন অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা কর্মকর্তা এবং ৯ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন।
অনেক সিনিয়র আইনজীবী মনে করেন, সেনা কর্মকর্তাদের বিচার প্রচলিত আইনেই সম্ভব এবং এতে কোনো বাধা নেই। তাঁরা বিডিআর বিদ্রোহে সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রচলিত আইনে সম্পন্ন হওয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, ফৌজদারি অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালে অগ্রসর হতে আইনি কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
অন্যদিকে, কয়েকজন সাবেক সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করছেন, সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ উঠলে সামরিক আইনে তাদের বিচার করার সুযোগ রয়েছে। তাঁদের মতে, এমন স্পর্শকাতর বিষয় জনসম্মুখে আসার আগে বাহিনীর অভ্যন্তরে আইনি প্রক্রিয়া ও তদন্ত পদ্ধতি পরিষ্কার হওয়া উচিত ছিল। সেনাবাহিনীর সম্মান ও মর্যাদার বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে তাঁরা মত দেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান বলেন, “এটি পুরো বিচার প্রক্রিয়ার অংশ, একে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এতে পুরো জাতি জড়িত। আমি মনে করি, যেভাবে প্রক্রিয়া এগোচ্ছে, সেটি যথাযথ। এটাকে ম্যাটার অফ ফ্যাক্টস হিসেবেই দেখা উচিত—পুরো প্রতিষ্ঠানকে টেনে আনা ঠিক হবে না।”
গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কোথায় রাখা হবে, তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “সাধারণ আইন অনুযায়ী, আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আদালতই নির্ধারণ করবেন তাদের কোথায় রাখা হবে।”
তবে সামরিক আইন ও সেনাবাহিনীর যুক্তিতে জানা গেছে, ২৫ জন আসামিকে সাময়িকভাবে সেনাবাহিনীর একটি ভবনে অস্থায়ী জেলখানা তৈরি করে সেখানে রাখা হয়েছে।
এ সিদ্ধান্তে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—কাশিমপুর বা কেরানীগঞ্জ কারাগারে না রেখে ক্যান্টনমেন্টে রাখার বিষয়টি কি ন্যায়বিচারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
দেশের সচেতন মহল ও সাধারণ জনগণ বলছেন, যদি সাবেক প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনের প্রধান, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও পুলিশ প্রধান পর্যন্ত কারাগারে থাকতে পারেন, তবে সেনা কর্মকর্তারা কেন ব্যতিক্রম হবেন? প্রজাতন্ত্রের যেকোনো ব্যক্তি যদি ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হন, তার বিচার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত—আইনের চোখে সবাই সমান, এটাই সংবিধানের মূলনীতি।
আইনগত দিক যাই হোক না কেন, একসঙ্গে এতজন সেনা কর্মকর্তার বিচারপ্রক্রিয়া সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ভবিষ্যতে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। পাশাপাশি, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সদস্য এবং অন্যান্য বাহিনীতে ডেপুটেশনে থাকা কর্মকর্তাদের মনোভাবেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
সর্বোপরি, সেনা কর্মকর্তাদের একসাথে এত বড় পরিসরে বিচার বাংলাদেশের রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ও সামরিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে—যার পরিণতি এখন জাতি দেখছে অপেক্ষায়!