নিশাত শাহরিয়ার
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, 2:01 PM
রাজনীতির রাজপথে বিএনপি কোন পথে
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের অগ্রযাত্রায় জোরালো ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেন নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিগত বছরগুলোতে দলটি আত্মত্যাগে, প্রতিরোধে এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে পার করেছে দীর্ঘ এক সংগ্রামী অভিযাত্রা। বাংলাদেশে যখনই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হয়েছে কিংবা মানুষ নিঃশ্বাস ফেলার স্বাধীনতাটুকুও হারিয়েছে তখনই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।
১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো তা পূরণে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রমনা বটমূলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান। দেশকে সমৃদ্ধ ও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে নেয়া নানা কর্মসূচির কারণে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল সমৃদ্ধ দেশ গঠনে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ। শহীদ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং দূরদর্শী বিভিন্ন কর্মসূচি তাকে দেশবাসীর কাছে ভীষণ জনপ্রিয় করে তুলেছিল খুবই অল্প সময়ে।
কিন্তু ১৯৮১-র ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য তাকে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে দলের হাল ধরেন সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। গৃহবধু থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিএনপি ফিরে পায় নতুন আশার আলো। রাজপথে তার আপোষহীন নেতৃত্ব স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করে। বেগম জিয়ার বাস্তববাদী ও আপোষহীন নেতৃত্বে বিএনপির পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার তৈরি হয় সারা দেশব্যাপী। জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় বিএনপি। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া আরো দুদফা জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পান। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়া হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের হাল ধরেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান। দলকে সুসংগঠিত করা, আন্দোলনে গতি আনা এবং রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করাসহ নতুন নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
কিন্তু পাঁচ দশক ধরে পথ চলা বিএনপির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে গত ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক নয়া সমীকরণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী দিনে বিএনপিকে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। বিগত দিনে দেয়া ৩১ দফা রূপরেখা যে কথার কথা নয় তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। দেশ পরিচালনায় তাদের অঙ্গীকারগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায়, ভবিষ্যত ফের চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে দলটির জন্য। জনআস্থা পেতে হলে বিএনপিকে দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজও করতে হবে। আগামীতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সকল নেতাকর্মীদের জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে পথ চলতে হবে।
তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কারণে দলটিকে সাধারণ জনগণের কাছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, বিএনপি’র প্রতিপক্ষ এখন অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নয় বরং বিএনপিই বিএনপি'র প্রতিপক্ষ। সারা দেশে দখলবাজি, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজ দলের নেতাকর্মীরা একে অপরের দুশমনে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে কমিটি গঠন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষ এবং মারামারি প্রতিনিয়তই নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। তাছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে একেকটি আসনে ৩ থেকে ৪ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী তো রয়েছেই। এতে করেও গ্রুপিং লবিং বাড়ছে সময়ের সাথে সাথে। বলা যায় তারা নিজেরাই এখন একে অন্যের প্রতিযোগী হয়ে মাঠে নেমেছেন। নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে কোথাও না কোথাও। এসব ঘটনায় দল হিসেবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
তাদের মতে, দখল, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় কর্মী কিংবা নেতার যেমন সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি’র ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এসব ঘটনা যত বেশি সংঘটিত হবে বিএনপি’র প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তত বেশি কমে আসবে। এই সুযোগ কাজে লাগাবে অন্যরা। যদিও দখল এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে বিএনপি’র হাইকমান্ড। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ৫ই আগস্টের পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সারা দেশে দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের চার থেকে সাড়ে চার হাজারেরও অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।